ভারতীয় দর্শনে চারটি পুরুষার্থের কথা আছে। এগুলো মানব জীবনের চারটি সঠিক লক্ষ্যকে বোঝায়। চারটি পুরুষার্থ হলঃ
১. ধর্ম (ধার্মিকতা, নৈতিক মূল্যবোধ),
২. অর্থ (সমৃদ্ধি, অর্থনৈতিক মূল্যবোধ),
৩. কাম (আনন্দ, প্রেম, মনস্তাত্ত্বিক মূল্যবোধ) এবং ৪. মোক্ষ (মুক্তি, আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ, আত্ম-বাস্তবতা)।
একজন ব্যক্তির জীবনের এই চারটি প্রিন্সিপাল সুনিশ্চিত হলে সে স্থিতিশীলতায় চলে আসে। আর এরকম ব্যক্তি সমষ্টি সমাজ ও রাষ্ট্র স্থিতিশীল থাকে।
এখানে ধর্মের বিষয়টি নৈতিক মূল্যবোধ, ধার্মিকতা বোঝালেও আমি একে একটু ভিন্নভাবে দেখে থাকি৷ ধার্মিকতা ও নৈতিক মূল্যবোধের আগে ব্যক্তির সাইকোলজিক্যাল ট্রেইট ও তার স্বভাব নিরীক্ষণটা বেশি জরুরী। ব্যক্তির স্বভাব যেটা নয় সে সেই দিকে গেলে তার ভেতরে মূল্যবোধগুলো তেমনভাবে বিকশিত হয় না। প্রতিটি ব্যক্তির তার নিজস্ব স্বভাব আছে। আর এই স্বভাব অনুসারে তার কর্ম ও ধর্ম নির্ধারিত হয়। কেউ যদি শিল্পী হয় তাহলে তার ধর্ম ও কর্ম এটাই হবে। এটা দিয়ে সে ক্যারিয়ার তৈরী করে উপার্জন করবে অর্থ। তারপর সেটা থেকে সে লাভ করবে কাম। তারপর এই তিনটি অর্থ নিষ্পত্তির পর সে মোক্ষের গভীর সাধনায় লিপ্ত হতে পারবে ঝামেলামুক্তভাবে। কেননা তার তিনটা অর্থ লাভ হয়ে গেছে। সে তখন দেখে ফেলবে এই দুনিয়া এমনই এই তিন বর্গই ঘুরেফিরে আসে। তারপর এটাতে সে হাঁপিয়ে উঠবে। এরপর স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সে মোক্ষের যাত্রায় পা বাড়াবে।
একজন ব্যক্তির স্বভাব অনুসারে কাজ না পেলে সে বরাবরই একটা অপূর্ণতায় ভোগে। যার ফলে কাজ করে কোটি টাকা কামালেও তার এই আফসোস দূর হয় না৷ কেননা দিনশেষে টাকা বস্তুগত সংসাধন মেটালেও একজন ব্যক্তির যে স্বভাবজাত কর্মের আনন্দ তা পেতে সে ব্যর্থ হয়। এজন্য একটা রাষ্ট্রের উচিত শিশু বয়স থেকেই একজন ব্যক্তির পরিবেশ, অবস্থা, জেনেটিক ইত্যাদি বিচার বিবেচনা অনুসারে তার কোনদিকে ঝোঁক বেশি সেদিকটায় যেন সে বেড়ে উঠতে পারে ও কাজ করে সমাজে ভূমিকা পালন করতে পারে সেই ক্ষেত্র নিশ্চিত করা।
সকলের দ্বারা সবকিছু সম্ভব হয় না। যে ভালো গাইতে পারে সে হয়তো ভালো গণিতে পারদর্শী হবে না। তাই প্রতিটি ব্যক্তি অনন্য বৈশিষ্ট্যকে এড্রেস করতে হবে। কোন ব্যক্তি যদি তার এই স্বভাবজাত ধর্ম খুঁজে পেয়ে যায় তাহলে তার অনেক বড় একটা পাজল সলভ হয়ে যাবে। রাষ্ট্রেরও উচিত এরকম একটা পরিবেশ ও ব্যাবস্থা সুনিশ্চিত করা যেন সবাই তার স্বভাবজাত ধর্ম খুঁজে পেতে সমর্থ হয়।
যখন কোন ব্যক্তি তার স্বভাবজাত ধর্ম অনুসারে বিকশিত হতে থাকে, কাজ করতে থাকে তখন আপনা থেকেই ঐ ব্যক্তির ভেতর তার নিজস্ব নৈতিক মূল্যবোধ, শৃঙ্খলা ও স্থিতি আসতে শুরু করে। কেননা যে কাজ সে করছে এটাতে সে নিজেকে নিরাপদ, যোগ্য, উদ্যমী ও কৌতূহলী অনুভব করে।
তারপর এই কাজ দ্বারা যখন সে সমাজে অবদান রাখবে। সমাজ তাকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি প্রদান করবে। এরপর সে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দিয়ে কামের বর্গ পূরণ করবে। ব্যক্তি তখন এ পর্যায়ে ধারাবাহিকভাবে প্রেমের শিল্পকলা, সম্পর্কের কলাকৌশল এসব সম্পর্কে চর্চা করবে। এগুলো জানা এজন্যই দরকার যে, এসবের জ্ঞান না হলে ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির সংঘর্ষের সৃষ্টি হবে। ফলে অস্থিতিশীলতা বাড়বে৷
এরপর এইসব কিছু করা যখন শেষ তখন ব্যক্তি দেখবে জীবন মোটাদাগে এই তিনেরই সংমিশ্রণ। এভাবে জীবনের শিল্পকলা শেখার পর সে অস্তিত্ব, মৃত্যু, মুক্তি ইত্যাদি আধ্যাত্মিক বিষয়ে স্বভাবগতভাবে সুস্থ্যভাবে প্রবেশ করতে পারবে। তারপর এই মৃত্যুর শিল্পকলা শেখার পর একজন ব্যক্তি এতটাই পরিপক্ব হয়ে উঠবে যে, তখন জন্মের পর যে ভীতি দিয়ে তার জীবনের যাত্রা শুরু হয়েছিল সেটা ভালোবাসা ও শান্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। তখন মৃত্যুকে সে সাদরে স্বাগত জানাতে পারবে। কারণ সে যে কারণে এই দুনিয়াতে এসেছিল সবকিছুই সে পূর্ণ করেছে ও দায়িত্ব পালন থেকে শুরু করে আনন্দ লাভ সবই সে করেছে। এখন তার কিছু চাওয়ার নেই, পাওয়ার নেই। এভাবেই সে গাছের একটি পরিপক্ব শুকনো পাতার মত তার জীবনের ইতিকে সাদরে বরণ করে নিতে পারবে।
এভাবে একজন ব্যক্তির এই চারটি পুরুষার্থ যখন পরিপূর্ণ হয় তখন সে সন্তুষ্ট হয়৷ আর এমন মূল্যবোধ সম্পন্ন সমাজ ও রাষ্ট্রে স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
এর একটির অভাব থাকলে সেখান থেকে নানা সমস্যার উদ্ভব হয়। আমাদের সমাজে ব্যক্তি পারসোনালিটি ট্রেইট এসব নিয়ে এনালিসিস হওয়া দরকার। যাতে করে একজন ব্যক্তি সমাজের সঠিক জায়গায় তার নিজ স্বভাবজাত ধর্ম অনুসারে কাজ করতে পারে৷ কেননা এটাই তাকে দীর্ঘমেয়াদি জীবনে অর্থ দিবে। আর অর্থপূর্ণ কাজ ব্যক্তি পেয়ে গেলে ও বুঝে গেলে টাকা তখন নগণ্য হয়ে ওঠে। কাজের আনন্দই তাকে অতি টাকার লোভের মোহকে দূর করে দিতে সক্ষম। ব্যক্তি যখন কাজ থেকে আনন্দ পেতে ব্যর্থ হয় তখন সে অধিক টাকা কামিয়ে তার আনন্দের ঘাটতি কামকেন্দ্রিক (এখানে কেবল যৌনতা নয়, যতপ্রকার ভোগবিলাস, সুখের মাধ্যম ইত্যাদি অর্থে) যত উপায় আছে সেসব উপায়ে তা পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এতে করে সমাজে আবার ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়।
আবার সমাজে যদি প্রেম, ভালোবাসা, সম্পর্ক এগুলো ট্যাবু হয়ে পড়ে তখন এই চাপ পুষিয়ে নেওয়া হয় ধর্ষণ, যুদ্ধ, বিগ্রহ, সন্ত্রাস ইত্যাদি সহ আরও নানা মাধ্যমে।
আর যদি অর্থনীতি ঠিক না থাকে তার ফলাফল তো আমরা এই ছাত্র আন্দোলনেই দেখলাম। বেকারত্ব তৈরী হলে কাজ পাওয়া যাবে না। কাজ না পেলে পাওয়া যাবে না অর্থ। আর অর্থ না পেলে কাম ও মোক্ষ কোনটাই সঠিকভাবে সম্ভব নয়৷
এজন্য একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্র ও সমাজ গঠন করতে হল এই চার পুরুষার্থ সুনিশ্চিত করার পদক্ষেপ ও প্রকল্প নিতে হবে। মানুষের জীবনে এই চারটি উদ্দেশ্য পূরণ ছাড়া মোটাদাগে আর তেমন কিছু নেই।
Discussion about this post
No posts